কেন এতো ধর্ষণ? নৈপথ্যে কি?
কলামিষ্ট কামরুজ্জামানঃ
সোশ্যাল মিডিয়া, পত্র পত্রিকা, টিভিসেটে চোখ রাখলেই একটা বীভৎস ভীতিকর নিউজ প্রত্যহ দেখতে পাই। একটা সকাল ও বোধ হয় বাংলাদেশে আসে না সেই বীভৎস ভীতিকর খবরটা ব্যতীত। হ্যা, আমি ধর্ষণের কথাই বলছি। ধর্ষণের খবর শুনতে শুনতে দেখতে দেখতে নিজেই মানসিক ভাবে এক প্রকার অস্থির হয়ে যাচ্ছি। কারণ মা বোন তো আমাদের ও আছে। কিছুদিন আগে পত্রিকার পাতা উল্টাতেই চোখে পড়ে শুধু ধর্ষণের খবর । কখনো শিশু ধর্ষণের খবর শুনি , কখনো যুবতী ধর্ষণের শুনি , কখনো কিশোরি ধর্ষণের কথা শুনি । এমন কি এই খবর শুনতে হয় শত বছর বয়সী অন্ধ বৃদ্ধাও ধর্ষিতা হতে। অর্থাৎ শিশু, কিশোরী, যুবতী, তরুণী এমন কি বৃদ্ধা মহিলাটাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ঘরে বাহিরে, রাস্তাঘাটে, চলন্ত বাসে, স্কুলে কলেজে, মাদরাসায় – ভার্সিটি তে কোথাও নারীরা নিরাপদ নয়, সুরক্ষিত নয়।
খবরটা শুনলেই আপাদমস্তক কেমন জানি এক প্রকার নিরেট হয়ে যায়। অপরাধ বোধে, লজ্জায়, আতঙ্গকে যেন মূক হয়ে যায়। তখন নিজের আত্মা চিৎকার করে যেন বলতে থাকে – ” কবিতায় আর কি লিখব? কবিতায় আর কি বলব? যখন ধর্ষকের নাপাক বীর্যের দখলে চলে গেছে আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ। ”
আজকে রিক্সাওয়ালা ধর্ষণ করে, বাসের হেল্পার ধর্ষণ করে, স্কুল কলেজ মাদ্রাসার শিক্ষক – অধ্যক্ষ ও ধর্ষণ করে। এমন কি মসজিদের ইমাম পর্যন্ত ধর্ষণ করে। কেন এতো ধর্ষণ? নৈপথ্যে কি?
আমরা যদি নিখুঁত ভাবে ভাবি তাহলে আমরা দুটি vital reason খুঁজে পাবো ধর্ষণের নৈপথ্যে।
১. আইনের অকার্যকরী প্রয়োগ।
২. ব্যাকওয়ার্ড দৃষ্টিভঙ্গি।
প্রথমে আইনের অকার্যকরী প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করি। হ্যা, বাংলাদেশে ধর্ষণ বিরোধী, নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে কয়েকটি বিধি বিধান আছে। সেগুলো হল –
ক) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ ( সংশোধনী – ২০০৩)
খ) দণ্ডবিধি ১৮৬০
গ) সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২
ঘ) ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৬০
এমন কি ধর্ষণের শাস্তি কি রূপ হবে? আইনের ৯ ধারায় তা লিপিবদ্ধ আছে। সেখানে ধর্ষণ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এর বিধানের কথাও লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু মেটার অব রিগরেট হল বাস্তবে আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। অর্থাৎ সাদাসিধে কথা – ” আইন আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই “।
আমাদের দেশে কোনো নারী ধর্ষিতা হলে আমরা কয়েকটা ঘটনা প্রত্যক্ষ করি। ঘটনা গুলো হল –
১. প্রতিবাদ র্যালী, মিছিল, মিটিং ও মানব বন্ধন কর্মসূচি।
২. রাষ্ট্রপ্রধানের নজরে পড়া। অত:পর ধর্ষিতার পরিবারকে রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে সমবেদনা ও আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা করা,
৩. তদন্ত কমিটি গঠন করা,
৪. তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন উদাও অর্থাৎ কারচুপি বা লোপাট হওয়া,
৫. রাজনৈতিক দলগুলোর অপরাজনীতি চর্চার নতুন ইস্যু তৈরি হয় এবং পাল্টাপাল্টি অভিযোগের বাক যুদ্ধ আরম্ভ হওয়া,
৬. খবরের কাগজে, টিভিসেটে টকশো তে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা, সমালোচনার ঝড় বয়ে যাওয়া ;
৭. ধর্ষিতা কি পর্দাশীল, নাকি বেপর্দা শীল তা নিয়ে গবেষণা করা ;
৮. ধর্ষিতা মারা গেলে বিভিন্ন সামাজিক ও মানবাধিকার সংস্থা গুলোর বিবৃতি প্রদান এবং কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ ;
৯. ধর্ষিতা মারা গেলে তদন্তের নামে, ডিএনএ টেস্টের নামে অহেতুক কয়েকবার ধর্ষিতার লাশ কবর থেকে উত্তোলন করা ;
১০. মামলা প্রত্যাহারের জন্য ধর্ষিতার পরিবারকে হুমকি ধমকি প্রদান ;
১১. ধর্ষিতা জীবিত থাকলে তাকে সামাজিকভাবে ও মানসিকভাবে টর্চার করে তার জীবনকে হেল করে দেওয়া কিংবা আত্মহননে বাধ্য করা।
এই হল আমাদের দেশে ধর্ষণ পরবর্তী ঘটনাদি। আমাদের দেশে আইন আছে। কিন্তু আইনের যথাযথ কার্যকরী প্রয়োগ নেই। তাই আমি আমাদের দেশের এই লক্কড় ঝক্কর, নড়বড়ে আইন ব্যবস্থাকে দোষারোপ করলাম। কারণ আমি মনে করি যে – আইনের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক কিছুই করা সম্ভব। অনেক অপরাধ দমানো যায়। ধর্ষণের অপরাধে যদি আমাদের দেশে একটাও দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দেওয়া হত তাহলে পরবর্তীতে আর কেউ ধর্ষণ করতে সাহস পেত না। ভয়ে বুক কাপত। অতএব, আমি মনে করি আমাদের দেশে আইনের যথাযথ প্রয়োগ বা ব্যবহারের অভাবে বাংলাদেশে আজ রেপ কালচার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত : আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দিন দিন ক্রমশ বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। মানুষের মধ্য থেকে মনুষ্যত্ব ব্যাপারটা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। পুরুষরা দিন হিংস্র ও কাপুরুষে পরিণত হচ্ছে। যে কাপুরুষ গুলো নারীর স্তন ভোগে হিংস্র হয়ে যায়, সে কাপুরুষ গুলো কি এটা ভাবে না – এই স্তন থেকে তারা দুগ্ধ পান করে বড় হয়েছে? যে কাপুরুষ গুলো নারীর যোনি ভোগে হিংস্র হয়ে যায়, সে কাপুরুষ গুলো কি এটা ভাবে না – এই যোনির মাধ্যমে তারা এই পৃথিবীতে এসেছে, এই পৃথিবীর আলো বাতাস দেখেছে? যে কাপুরুষ গুলো নারীর দেহ ভোগে হিংস্র হয়ে যায়, সে কাপুরুষ গুলো কি এটা ভাবে না – এই দেহের শক্তি সামর্থ্য দ্বারা কোনো একজন নারী তাদের লালন পালন করেছে? সে কাপুরুষ গুলো কি এটা ভাবে না – যাকে ধর্ষণ করছি সে যেমন একজন নারী, তার মাও একজন নারী।
অতএব আমাদেরকে ব্যাকওয়ার্ড দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। সুস্থ মানসিকতার চর্চা করতে হবে। আরো বেশি মানবিক হতে হবে। পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। অন্যথায়, সে দিন আর বেশি দূরে নয়, যে দিন পৃথিবী আবার নতুন করে জানবে ধর্ষনের জন্য কুখ্যাত নয়াদিল্লী নয়, ধর্ষণের জন্য কুখ্যাত – বাংলাদেশ!
লেখক : কবি ও কলামিস্ট